একটি সুন্দর, সহজে ব্যবহারযোগ্য ও কার্যকর ওয়েবসাইট তৈরি করতে হলে প্রথমে একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং সে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ওয়েবসাইট পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য ওয়েব ডিজাইনার এবং ডেভেলপারকে একসাথে কাজ করা জরুরী। ওয়েবসাইট পরিকল্পনায় ব্যবসার ধরণ, সময়, অর্থ, প্রযুক্তি ও ব্যবসার ব্যাপ্তি – এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। শুধু ওয়েবসাইট তৈরিই নয়, ওয়েবসাইটের পেইজ সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে ঠিক মত ইনডেক্স করেছে কিনা এবং ওয়েবসাইটের ব্যবহারকারীরা ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছে কিনা তাও নিশ্চিত করার প্রয়োজন হয়। আজকে আমরা এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধাপে ধাপে জানার চেষ্টা করব।
ডোমেইন এবং হোস্টিং:
ডোমেইন হলো কোনো ওয়েবসাইটের ঠিকানা, যেমন reviewdin.com। ডোমেইন যত ছোট, সুন্দর, সহজে মনে রাখার মত, সহজে বানান করা যায় এমন এবং আপনার ব্রান্ড বা ব্যবসার সাথে সংগতিপূর্ণ হবে, ততই ভালো। অনলাইনে সহজে ব্যবহারযোগ্য সুন্দর ও প্রাসঙ্গিক একটি নাম অধিক গ্রাহক আকর্ষণ করতে ও সার্চ ইঞ্জিনে সহজে ইন্ডেক্স হতে সহায়তা করে, যা আপনার ব্যবসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হোস্টিং বা হোস্টিং সেবা হলো এমন একটি কম্পিউটার যেখানে আপনার ওয়েবসাইট সংরক্ষিত থাকবে এবং কেউ ব্রাউজারে আপনার ওয়েবসাইটের ঠিকানা লিখে প্রবেশ করতে চাইলে সার্ভার আপনার ওয়েবসাইটের নির্ধারিত পেইজকে ঐ ব্যবহারকারীর ব্রাউজারে পাঠাবে। হোস্টিং সেবা প্রদানকারীকে সতর্কতার সাথে নির্বাচন করা খুবই জরুরী। আপনার ওয়েবসাইটের ধরণ কেমন হবে, ওয়েবসাইটে ছবি ও ভিডিও বেশি থাকবে, নাকি কম্পিউটিং পাওয়ার বেশি খরচ হয় এমন সার্ভিস থাকবে? আপনি নিজে টেকনিক্যাল সমস্যার সমাধান করতে পারবেন বা আপনার প্রতিষ্ঠানে এসব কাজের দক্ষ কর্মী আছে কিনা? ওয়েবসাইটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা কেমন হবে? অনলাইনে লেনদেন কেমন হবে? হোস্টিং সেবা প্রদানকারীর সার্ভার ব্যাকআপ সুবিধা কেমন? সিডিএন ও নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি সেবা কেমন? অনলাইনে হোস্টং সেবা প্রদানকারী কোম্পানির রিভিউ কেমন এবং তাদের সার্ভার আপটাইম, স্কেলেবিলিটি ও গ্রাহকসেবা সন্তোষজনক কিনা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাকএন্ড পরিষেবা – সিএমএস/সফটওয়্যার
কোনো ওয়েবসাইটের জন্য ভালো মানের ও স্কেলেবল প্রযুক্তি নির্বাচন করা অত্যান্ত জরুরী। ঊদাহরণস্বরূপ, আপনার সুন্দর একটি গাড়ি থাকলে আপনার বন্ধুরা সে গাড়ির ডিজাইন, রঙ ইত্যাদি দেখে আকর্ষণ অনুভব করবে। কিন্তু আপনি জানেন যে, শুধু গাড়ির ডিজাইন সুন্দর হলেই হবে না, তার ভিতরে শক্তিশালী ইঞ্জিন না থাকলে গাড়িটি তার আকর্ষণীয় ডিজাইন অনুযায়ী সেবা দিতে পারবে না। ঠিক একইভাবে, ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রেও সঠিক সিএমএস, ডেটাবেইজ, সার্ভার সফটওয়্যার ইত্যাদি নির্বাচন খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
পরিষ্কার ডিজাইন ও ব্রান্ডিং
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওয়েবসাইট ডিজাইনের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় গ্রাফিক্স ও টেক্স যুক্ত করে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তা ব্যবহারকারীর জন্য উপকারী হয় না। এর ফলে ব্যবহারকারী মূল কন্টেন্টে মনোযোগী হতে পারে না এবং ব্যবসায় প্রত্যাশিত কনভারসন বা বিক্রি হয় না। ওয়েবসাইট ডিজানের ক্ষেত্রে পরিষ্কার ডিজাইনের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে, অপ্রয়োজনীয় কনটেন্ট পরিহার করতে হবে এবং ডিজাইনের মাধ্যমে ব্রান্ডকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। ওয়েবসাইটের লোগো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ, যা সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। অফলাইন এবং অনলাইন প্রচারণার ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স এবং লোগোর সমন্বয় রাখতে হবে।
রঙ নির্বাচন
সঠিক রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক সময় কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সঠিক রঙ আপনার ওয়েবসাইট ও ব্রান্ডের সফলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কোন রঙ মনকে প্রশান্ত করে বা সুখানুভূতি জাগায়, আবার কোন রঙ মানুষকে হতাশ করে? আপনার টার্গেট কাস্টমার বা ওয়েবসাইটের ব্যবহারকারী কোন শ্রেণির মানুষ? এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রঙ নির্বাচন করতে হবে। আপনার ব্রান্ডের সাথে একটি রঙ বা দুইটি রঙ নাকি দুইয়ের অধিক রঙ ব্যবহার করবেন তা সতর্কতার সাথে বিবেনায় রাখুন। ব্রান্ড কালারকে যতটা সম্ভব ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।
ফাংশনালিটি বা কার্যকারিতা
ফাংশনালিটি সম্পর্কে চিন্তা করার সময়, কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা উচিত। যেমন, ওয়েবসাইটটি কি আক্ষরিক অর্থে কার্যকরী? লোডিংয়ের সমস্যা বা ব্রোকেন লিঙ্ক আছে? সাইটের নিরাপত্তা ফিচারগুলো কি আপনার ব্যবসায়িক প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত? এই অপারেশনাল সমস্যাগুলো ছাড়াও, ব্যবহারকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার ওয়েবসাইটের বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সাইটের যোগাযোগের ফর্ম, জরিপ এবং গ্রাহকের প্রতিক্রিয়া বিভাগগুলো কি সঠিকভাবে কাজ করছে? এরকম এক বা একাধিক সমস্যা থাকলে ব্যবহারকারী আপনার ওয়েবসাইট ছেড়ে চলে যেতে পারে।
নেভিগেশন সহজ করা বা সহজে ব্যবহারযোগ্য করা
যদি ওয়েবসাইট বিভ্রান্তজনক হয় এবং নেভিগেট করতে অসুবিধা হয় তবে আপনার গ্রাহকরা চলে যেতে পারে এবং কখনও ফিরে আসার আগ্রহ নাও দেখাতে পারে। আপনার সাইটের নেভিগেশনের দক্ষতা এবং আবেদন বাড়ানোর জন্য গভীরভাবে সাইট পর্যবেক্ষেন করুন, যেনো আপনিই সাইটে নতুন পরিদর্শনকারী। ন্যাভিগেশন স্ট্রিমগুলি অনুধাবন করুন এবং যেগুলো ব্যবহার করতে অসুবিধা হয় সেগুলো নোট করুন। আপনার সাইটের নেভিগেশন উন্নত করতে ব্যবহারকারীদের জন্য একটি সাইটম্যাপ তৈরি করতে পারেন (যা সার্চ ইঞ্জিনগুলোর জন্যও আপনার ওয়েবসাইটকে ইনডেক্স করতে সুবিধা হবে)। যে লিংকগুলো কাজ করছে না সেগুলো সরিয়ে দিলে আপনার ওয়েবসাইটের পারফরম্যান্স বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্রান্ড মানও বৃদ্ধি পাবে।
কল টু অ্যাকশন
আপনার ওয়েবসাইটে গ্রাহকদের জন্য কল টু অ্যাকশন বা কিছু করতে আমন্ত্রণ জানালে তা গ্রাহকদেরকে আপনার সাথে যোগাযোগ বা পণ্য ও সেবা ক্রয়ে উৎসাহিত করবে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন গ্রাহক হলে সাবস্ক্রাইব করতে আমন্ত্রণ জানানো, ইতোমধ্যে পরিচিত গ্রাহক হলে গ্রাহক লয়ালিটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো, পণ্য বা সবা ক্রয় করার বাটন বা লিংক যথা স্থানে রাখা ইত্যাদি আপনার ওয়েবসাইটের কার্যকরিতা বৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক সফলতায় ভূমিকা রাখবে।
দ্রুত লোড হওয়া, এসইও বান্ধব, ব্লগ ও রেসপনসিভনেস, সোস্যাল মিডিয়া
ওয়েবসাইট লোড হতে বিলম্ব হলে গ্রাহকের সে ওয়েবসাইট পরিত্যাগ করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ওয়েবসাইটের কোড এবং কনটেন্ট এমনভাবে তৈরি করা উচিত যা সার্চ ইঞ্জিনকে ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ইনডেক্স করতে সহায়তা করবে। আপনার ওয়েবসাইটে ব্লগ রাখতে পারেন, যা সার্চ ইঞ্জিনকে ইনডেক্স করতে ও গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে সহায়তা করবে। বিভিন্ন ডিভাইসে আপনার ওয়েবসাইট দেখতে ও ব্যবহার করতে সমস্যা হলে গ্রাহক ওয়েবসাইট ত্যাগ করবে। এক্ষেত্রে ডিভাইস রেসপনসিভ ডিজাইন করতে হবে ও বাজেট থাকলে মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে। ওয়েবসাইট কনন্টেন্ট সোস্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করার সুবিধা রাখা এবং নামকরা ওয়েবসাইটগুলোর অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আপনার ওয়েবসাইটে সাইন ইন ও লগইন করার ব্যবস্থা থাকলে তা গ্রাহকদের জন্য ওয়েবসাইট ব্যবহারকে অনেক সহজলভ্য করে দিবে।
ক্যাপচা টেস্ট ও নিরাপত্তা
বিভিন্ন ধরনের বোট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে ক্যাপচা টেস্ট যুক্ত করা হয়। বর্তমানে প্রায় সব ধরণের ওয়েবসাইটেই ক্যাপচা টেস্ট এর নিরাপত্তা যুক্ত করা হয়।
প্রযুক্তির বিবর্তনের সাথে সাথে আরও নতুন ও উন্নত নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলো আপনার ওয়েবসাইটের সততাকে আপস করার হুমকি দেয়। ম্যালওয়্যার এবং ভাইরাস থেকে শুরু করে দূষিত অ্যাপ্লিকেশন এবং হ্যাকারদের হুমকি ইত্যাদি থেকে ওয়েবসাইটে সুরক্ষা দিতে ওয়েবসাইকে অবশ্যই ফ্রন্ট এন্ড এবং ব্যাক এন্ড উভয় দিক থেকেই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইন লেনদেন করার জন্য নির্মিত ওয়েবসাইটগুলো, যেমন ইকমার্স সাইটগুলোতে গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা প্রয়োজন। ব্রাউজার-ভিত্তিক হুমকির সম্ভাবনা হ্রাস করার জন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাদের ওয়েবসাইটগুলোতে এসএসএল সার্টিফিকেট যুক্ত করা। ওয়েবসাইট তৈরির সময়, আপনার সাইটের ফ্রেমওয়ার্ক এবং ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত সুরক্ষা বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেসব প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা সেবা ও পণ্য সরবরাহ করে প্রয়োজনে তাদের সেবা ও পণ্য গ্রহণ করা যেতে পারে।
গ্রাহক রিভিউ ও ট্রাকিং
অনেক ওয়েবসাইট ও ব্যবসার ভিড়ে আপনার ওয়েবসাইটে গ্রাহক আকর্ষণ করা, গ্রাহকদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করা, নতুন গ্রাহকদেরকে ধরে রাখতে ওয়েবসাইট ডিজাইন ও কনটেন্ট তৈরির সময় উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে এবং গ্রাহক ট্রাকিং করার প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ওয়েবসাইটে গ্রাহকদের রিভিউ/টেস্টিমনিয়াল যুক্ত করা যায় এবং গুগল অ্যানালিটিক্স ও ফেইসবুক পিক্সেলের মত ট্রাকিং সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর সহায়তায় গ্রাহক ট্রাকিং করা যায়, যা আপনাকে ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের ও ওয়েবসাইটে তাদের কার্যক্রমের বিস্তারিত প্রতিবেদন পেতে, গ্রাহকদেরকে টার্গেট করতে ও সে অনুযায়ী ক্যাম্পেইন ডিজাইন করতে সহায়তা করবে।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো থেকে সহজেই বুঝা যায়, একটি সুন্দর ও কার্যকর ওয়েবসাইট তৈরিতে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাজেট সংকুলতার জন্য প্রায়ই অনেক বিষয় উপেক্ষা করা হয়। তবে আমরা আশা করছি উপরিউক্ত ধারনাগুলো আপনাকে একটি কার্যকর ওয়েবসাইট তৈরিতে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।
2 Comments
একটি আধুনিক ডিজাইনসহ, স্পীড এবং (seo) অপটিমাইজড ওয়েবসাইট তৈরি করতে আপনার 30-40 হাজার টাকা খরচ আসবে।
আপনি যে ফিচার বলছেন সেগুলো দিয়ে ওয়েবসাইট বানাতে খরচ কেমন হবে? গ্রোসারি আইটেম বিক্রি হবে ওয়েবসাইটে।
জানালে খুশি হব।